30 C
Bangladesh
বৃহস্পতিবার, জুলাই ২৫, ২০২৪

দক্ষ মানব সম্পদ গড়ে তুলতে আধুনিক ও যুগোপযোগী প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়ন জরুরী

জাতীয়দক্ষ মানব সম্পদ গড়ে তুলতে আধুনিক ও যুগোপযোগী প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়ন জরুরী
বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব আর অসীম সাহসিকতায় বাংলাদেশ তর তর করে এগিয়ে যাচ্ছে উন্নয়নের মূল রূপরেখায়। বাংলাদেশ ক্রমাগত বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। আমরা এখন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কথা বলছি, যা আজ বৈশ্বিক পরিমন্ডলে এক বাস্তবতা। এটি মোকাবেলায় প্রয়োজন দক্ষ মানবসম্পদ। আর মানবসম্পদ তৈরি করতে প্রয়োজন শিক্ষা। যদিও শিক্ষা ক্ষেত্রে আমরা বেশ এগিয়েছি।
স্বাধীনতা লগ্নে বাংলাদেশের সাক্ষরতার হার ছিল মাত্র ১৬ শতাংশের বেশি, আর মাত্র অর্ধশত বছরেই বাংলাদেশের সাক্ষরতার হারকে ৭৫ শতংশে ছুঁয়ে ফেলেছি। এর মানে দেশের চার ভাগের তিন ভাগ মানুষ মোটামুটি পড়তে ও লিখতে জানে। কিন্তু জাতীয় শিক্ষার্থী মূল্যায়ন (এনএসএ) তথ্য বলছে, প্রাথমিক স্তরে এখনো বাংলা ও গণিতে কাঙ্ক্ষিত দক্ষতা অর্জনের হার সন্তোষজনক নয়।  যদিও শিক্ষা উন্নয়ন প্রকল্প-৪-এর আওতায় ২০২৩ সালের মধ্যে বেশকিছু লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সরকার, কিন্তু বাস্তবে এর ফলাফল খুব একটা দৃশ্যমান নয়।  ২০২৩ সালের মধ্যে পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের বাংলা বিষয়ে ন্যূনতম দক্ষতা (ব্যান্ড ৫) অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৬০ শতাংশ। ২০১৫ সালে এ হার ছিল ২৩ শতাংশ। ২০১৭ সালে এসে এ হার কমে ১২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। একইভাবে ২০২৩ সালের মধ্যে গণিতে ন্যূনতম দক্ষতা (ব্যান্ড ৫) অর্জনকারী শিক্ষার্থীর হারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৫০ শতাংশ। ২০১৫ সালে এ হার ছিল মাত্র ১০ শতাংশ। ২০১৭ সালে এ হার বেড়ে দাঁড়ায় ১৭ শতাংশে (বণিক বার্তা, ১৯ জানুয়ারি ২০২০)। তাই প্রশ্ন থেকে যায়, আমরা আসলে কতটা দক্ষ মানব সম্পদ গড়ে তুলতে পেরেছি। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকতে উচ্চশিক্ষাকে নতুন করে সাজানোর কথা বলেছেন। রাষ্ট্রপতির বক্তব্যের আলোকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন চতুর্থ শিল্প বিপ্লব উপযোগী জনশক্তি তৈরির লক্ষ্যে শিক্ষা ব্যবস্থা নতুন করে সাজাবে বলে প্রত্যাশা। বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসুক, এবং দক্ষ জনশক্তি তৈরি হোক এটা আমাদের লক্ষ্য। কিন্তু গোঁড়ায় গলদ থেকে গেলে আমাদের সব স্বপ্নই ধূলিসাৎ হয়ে যেতে পারে।
উচ্চ শিক্ষার দিকে নজর দেয়ার সাথে সাথে আমাদের উচিৎ প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে সমান তালে নজর দেয়া। বলা হয়ে থাকে, জন্মের পর থেকে ১০ বছর বয়সে পৌঁছানো পর্যন্ত সময়ই শিশুর মস্তিষ্ক বিকাশের জন্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। এ বয়সেই শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশ, সৃজনশীলতা, অনুসন্ধিৎসা প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিভা বিকশিত হয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘শিশুদের যথাযথ শিক্ষার ব্যত্যয় ঘটলে কষ্টার্জিত স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে পড়বে।‘ এছাড়া বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে বিনামূল্যে বই, শিক্ষা উপকরণ ও খাবার বিতরণের ব্যবস্থা করেছিলেন। আর তার সময়ই সারাদেশে গড়ে তোলা হয় অসংখ্য প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রাথমিক শিক্ষাকে যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে ১৯৭৩ সালে ৩৬ হাজার ১৬৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ এবং ১ লক্ষ ৫৭ হাজার ৭২৪ জন শিক্ষকের চাকুরি সরকারিকরণের মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষার অগ্রগতির সোপান রচনা করেন।
একটা সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশের ভাগ্য নির্ধারণে বঙ্গবন্ধু যে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তা ছিল অন্যান্য ও অসাধারণ। কিন্তু আজ স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় কেমন জানি তাল-মাতাল অবস্থা। প্রযুক্তিহীন সৃজনশীলতা, দক্ষ শিক্ষকের অভাব, দুর্বল অবকাঠামো এগুলোই প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার চালিকাশক্তি। দক্ষ শিক্ষক-তো দূরের কথা বেশকিছু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাত্র একজন শিক্ষক দিয়েই পাঠদান চলছে।প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অ্যানুয়াল সেক্টর পারফরম্যান্স রিপোর্ট ২০১৮ অনুযায়ী, একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কমপক্ষে চারজন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন। অথচঃ রিপোর্টে দেখা যায় যে, দেশের ৭৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাত্র একজন শিক্ষক দিয়ে পাঠদান চলছে, ৭২১ বিদ্যালয়ে আছেন মাত্র দুজন শিক্ষক । আর তিনজন শিক্ষক দিয়ে পাঠদান চলছে ৭ হাজার ৭৬৪ বিদ্যালয়ে। অর্থাৎ সরকারি হিসাবেই ৮ হাজার ৫৬৪টি বিদ্যালয়ে তীব্র শিক্ষক সংকট রয়েছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন জাতীয় সংসদকে জানিয়েছেন, বর্তমানে দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ৫ হাজার ৬২৬টি জরাজীর্ণ (প্রথম আলো, ১৯ জুন ২০২০)। এই হলো প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বর্তমান হালচাল। একজন প্রাথমিক শিক্ষক হিসেবে বেশ জোড়ালভাবেই বলতে পারি, জাতির ভবিষ্যৎ ভীত আমাদের হাতেই রচিত হয়। গোঁটা পৃথিবী যেখানে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সাথে এডুকেশন-৪ এর কথা বলছে, সেখানে যদি প্রাথমিক শিক্ষাকে বাদ দিয়ে শুধু উচ্চশিক্ষায় প্রযুক্তি ও সৃজনশীলতা আনয়নে মননিবেশ করেন সেটা বোধহয় সঠিক সিদ্ধান্ত হবেনা। এখনো প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় উচ্চশিক্ষিত তরুণদের কেমন জানি নাক ছিটকানো ভাব রয়েই গেছে। দক্ষ উচ্চ শিক্ষিত তরুনরা এই পেশায় আসতে চান না।  এর কারণ নানবিধ হতে পারে, তবে বাহ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে আমার কাছে নিম্নবর্ণিত কারনগুলোই মুখ্য হিসেবে পরিগণিত হয়-
  • নিম্নতর গ্রেড, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ সাধারণত ১৩তম গ্রেডে নিয়োগ পেয়ে থাকেন, সরকারি অন্যান্য অফিসসমূহে যা মূলতঃ একজন চতুর্থ অথবা তৃতীয় শ্রেণী কর্মচারীর সমমর্যাদার।
  • সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন সর্বসাকুল্যে ১৯,০০০ টাকা, যা খুবই সামান্য। বেতন-ভাতার স্বল্পতার কারণে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ শিক্ষক এটা থেকে দূরে চলে যাচ্ছেন।
  • বদলীজনিত সমস্যা, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথী তার নিজ জেলায় নিয়োগ পেয়ে থাকেন। পরবর্তী পর্যায় নিজ সুবিধা মতো প্রতিষ্ঠানে বদলি হতে চাইলে নানা প্রশাসনিক বাঁধার সম্মুখীন হতে হয়।
  • শিক্ষকদের যথাসময়ে পদোন্নতি না হওয়ায় তাঁরা শিক্ষাদানে অমনোযোগী ও অনীহা প্রকাশ করেন।
  • প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নে প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনায় কিছুটা ঘাটতি রয়েছে, যা বাধা প্রদান করে।
বৈশ্বিক চাহিদা অনুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য উপর্যুক্ত সমস্যাগুলি সমাধান করার সাথে সাথে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় বেশকিছু পরিবর্তন আনা জরুরী। বিশ্বব্যপি যেহেতু পুঁথিগত বিদ্যার পরিবর্তে এখন কর্মমুখী তথা প্রযুক্তিনির্ভর অর্থাৎ কারিগরি শিক্ষায় গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। সেহেতু আমাদের এ প্রচেষ্টার ভীত প্রাথমিক স্তর থেকেই শুরু করতে হবে। বর্তমানে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীরা ক্লাস রুমের পরিবর্তে স্মার্ট ফোন অথবা অনলাইন গেইমিং-এ বেশি আকৃষ্ট তাই আমাদের পড়ানোর ধরণের পরিবর্তন আনতে হবে। পড়াশোনায় বৈচিত্র্য বাড়ানো দরকার। আমাদের যেমন গণিত নিয়ে পড়তে হবে, তেমনি পড়তে হবে শিল্প-সংস্কৃতি নিয়ে। প্রোগ্রামিংসহ বিভিন্ন প্রাথমিক দক্ষতা সবার মধ্যে থাকা এখন ভীষণ জরুরি। প্রচলিত ক্লাসরুমের পরিবর্তে ই-লার্নিং, স্মার্ট ক্লাসরুম অথবা মাল্টিমিডিয়া ভিত্তিক ক্লাসরুম শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে বেশ ভূমিকা পালন করতে পারে। অর্থাৎ প্রযুক্তিগতভাবে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার উপযোগী শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করতে হবে। সেইসাথে তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণমুখী ব্যবহার নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি ইন্টারনেট, ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ক্ষতিকর  দিক সম্পর্কে শিশুদের অবহিত করতে হবে। আর এ দায়িত্ব শিক্ষকদের পাশাপাশি পরিবারের সদস্যদেরও পালন করতে হবে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈতিকতার পদস্খলন আজকাল আমাদের বেশ ভাবিয়ে তুলছে। সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকার সাভারে শিক্ষার্থী কর্তৃক শিক্ষক হত্যা কিংবা কলেজের ছাত্র ও স্থানীয় কিছু ব্যক্তি কর্তৃক নড়াইলের শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় পুলিশের সামনেই জুতার মালা পরানো ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য অশনি সংকেত। এ বিষয়গুলোকে বিবেচনায় রেখে প্রাথমিক শিক্ষায় নৈতিকতা ও মূল্যবোধ বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্তকরণ ও চর্চা করানোর মাধ্যমে শিশুর চিন্তা শক্তিকে সঠিক ধারায় প্রবাহিত করবে।শিশুরাই আগামীর বাংলাদেশেকে নেতৃত্ব দিবে, তাই আজকের শিশুদের উপর নির্ভর করছে আগামীর বাংলাদেশ।
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তারই সুযোগ্যকন্যা বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও শিশুদের অধিকার সুরক্ষায় এবং একই সঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। টেকসই উন্নয়ন কর্মপরিকল্পনায় শিক্ষার মানোন্নয়নে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন লক্ষ্যমাত্রা ও কার্যপদ্ধতি নির্ধারণ করা হয়েছে এবং এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশেও শিক্ষার মানোন্নয়নে নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তিই রচিত হয় প্রাথমিক শিক্ষার মাধ্যমে। তাই শিক্ষা ব্যবস্থার এ স্তরে বিদ্যমান সমস্যাগুলি দূর করে আধুনিক ও যুগোপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়ন এখন সময়ের দাবী।

~মোসাঃ তাজেনুর আক্তার
সহকারী শিক্ষক
পাথরঘাটা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বরগুনা।

Check out our other content

Check out other tags:

Most Popular Articles