28 C
Bangladesh
মঙ্গলবার, জুলাই ২৩, ২০২৪

বাংলাদেশের হাওর অঞ্চলে মানুষের অবস্থা 

মতামত ও ফিচারবাংলাদেশের হাওর অঞ্চলে মানুষের অবস্থা 
আমাদের প্রয়োজনীয় বেশির ভাগ চালই আসে বোরো ধান থেকে। আর এই বোরো ধানের এক-চতুর্থাংশই উৎপন্ন হয় হাওরাঞ্চলে। আবার হাওরাঞ্চলের একমাত্র ফসলও এই বোরো ধান। কোনো বছর আগাম বন্যায় বোরো ধানের ক্ষতি হলে স্থানীয়দের দুঃখ-কষ্টের সীমা থাকে না। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আগাম বন্যার প্রকোপ ক্রমেই বাড়ছে।
হাওর এলাকার বাঁধ ভাঙা যেন একরকমের স্বভাবিক নিয়মে পরিণত হয়ে দাঁড়িয়েছে। উজানি ঢল ও প্রবল বৃষ্টির কারণে প্রতিবছরই দেশের হাওর অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়ে থাকে। এবারেও উজানি ঢলের কারণে বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হয়েছে।এদিকে ভারতের আসাম ও মেঘালয়ে থেকে বয়ে আসা বৃষ্টির পানিতে সুরমা নদীর পানি বেড়েছে। এ অবস্থায় ফসল নষ্ট হওয়ার শঙ্কায় রয়েছেন চাষিরা।
টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে নেত্রকোনা ও সুনামগঞ্জে নদনদীর পানি বাড়ছে। সেই সাথে বাঁধ ভেঙে তলিয়ে গেছে নীচু ফসিল জমিজমা। আবাদি ফসিল জমিজমা তলিয়ে যাওয়ায় অসহায় অবস্থায় জীবনযাপন করছে নিম্ন আয়ের মানুষজন। বন্যায় বাঁধ ভেঙে তলিয়ে যাচ্ছে বিস্তীর্ণ এলাকা। নদীভাঙনে বিলীন হচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। কিন্তু কেন? দেশজুড়ে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে নদীভাঙন ও বন্যা রক্ষা বাঁধ। এর পরও বছর ঘুরতে না ঘুরতে ভেঙে যায় সেই বাঁধ।
অন্যদিকে ভুক্তভোগী কৃষকদের মতে, হাওরাঞ্চলে প্রতি বছর বাঁধ নির্মিত হয় আর আগাম বর্নায় পানির তোড়ে ভেঙে যায়। কিছু এলাকায় স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ না করায় বাঁধ ভেঙে জমিতে বালি প্রবেশ করে আবাদি জমি নষ্ট হয়। অথচ দেশের হাওর এলাকায় বোরো আবাদ সবচেয়ে বেশি হয়। আর আকস্মিকভাবে পাহাড়ি ঢল বা আগাম বৃষ্টি হলে হাওরগুলোতে পানি এসে গেলে হাওরের উঠতি বোরো ফসল তলিয়ে যায়। কৃষকরা পাকা ধান আর ঘরে তুলতে পারেন না। সেজন্যই বাঁধ নির্মাণ খুব প্রয়োজন। আবার জমিতে বালি ঢুকে গেলে পরের বছর সেখানে ভালো ফসলও হয় না। যদিও প্রতি বছরই ডুবে থাকা বাঁধগুলো সংস্কার করা হয়, কিছু বাঁধ নতুন করে নির্মাণও করা হয়। কিন্তু কৃষকের জমি রক্ষার স্বার্থে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ জরুরি।
দেশের ফসলের ২০ ভাগ আসে হাওরাঞ্চল থেকে। হাওরে বোরোর ফসলহানি ঘটলে স্বাভাবিকভাবে হুমকিতে পড়ে যায় খাদ্যনিরাপত্তাও। চালের বাজার অস্থির হয়ে ওঠে। এ অবস্থায় হাওরের অব্যবস্থাপনা ও অসংগতিগুলো দূর করার বিকল্প নেই।
২০১৭ সালের বন্যায় হাওরে ফসলহানির পর বাঁধ নির্মাণে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ঠিকাদারি পদ্ধতি বাতিল করে পিআইসির মাধ্যমে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয়। বাঁধ নির্মাণে নতুন নীতিমালা করে ঠিকাদারি প্রথা বাতিল করে সরাসরি যুক্ত করা হয় জেলা ও উপজেলা প্রশাসনকে। এখন তারাও যদি ব্যর্থ হয় তাহলে তা হতাশাজনকই বটে। সাংগঠনিক দুর্বলতার পাশাপাশি হাওরে বাঁধ নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রকৌশলগত ঘাটতিও বিরাজমান। নিয়ম অনুযায়ী বাঁধের ৫০ মিটার দূর থেকে মাটি কাটার কথা থাকলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাঁধের পাড় থেকে মাটি কেটে বাঁধ দেয়া হয়। এভাবে নির্মাণের ফলে বাঁধ দুর্বল হয়। বাঁধে একটি নির্দিষ্ট ঢাল থাকার কথা (২:১), কিন্তু অনেক বাঁধই খাড়া থাকায় পানির তোড়ে সহজেই ভেঙে যায়।
দেশের বিস্তীর্ণ হাওর অঞ্চল গড়ে উঠেছে প্রাকৃতিকভাবে। এখানে বসবাস করতে গিয়ে মানুষ নানাভাবে হাওরের স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করছে। অপরিকল্পিত ও অসমন্বিত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডও হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে হাওরের জীববৈচিত্র্য। এ বাস্তবতায় হাওর এলাকার জন্য উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও সেসব বাস্তবায়ন করতে হবে প্রকৃতিকে গুরুত্ব দিয়ে। হাওর বাঁচাতে হলে বিদ্যমান বাঁধগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ, প্রয়োজনে পানিপ্রবাহে বিঘ্ন সৃষ্টিকারী বাঁধগুলো অপসারণ করে পুনরায় পরিকল্পনামাফিক বাঁধ নির্মাণ করার বিষয়টি বিবেচনা করার কথা উঠে আসছে বারবার। যেসব বাঁধ নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে, সেগুলোর ডিজাইন পুনরায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তারপর অনুমোদন দেয়ার বিষয়টিও বিবেচ্য।
হাওরাঞ্চলের কৃষকের রয়েছে তিক্ত অভিজ্ঞতা। সেখানে বন্যা এলে একমাত্র বাঁধই রক্ষা করতে পারে তাদের শ্রমে-ঘামে ফলানো ‘সোনার ধান’। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বাঁধগুলো সংস্কার না করলে শুধু যে ওই এলাকার কৃষকেরই সর্বনাশ হবে তা নয়; বরং পুরো দেশই খাদ্য নিরাপত্তার হুমকির মুখে পড়বে। প্রশ্ন হচ্ছে, নির্ধারিত সময়ে কেন এসব বাঁধ সংস্কার বা নির্মাণ করা হয়নি। এখন বন্যা হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে; এর আগে কি বাকি কাজ শেষ করা যাবে?
নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের এত অনাগ্রহ ও উদাসীনতার কারণ কী-আমরা সেটা জানতে চাই। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যদি কোন প্রকল্পের কাজ শেষই করা না যায়, তাহলে সময় নির্ধারণ করার দরকার কী! প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা তাদের খেয়াল-খুশিমতো কাজ করুক। কৃষকের ফসল ডোবে তো ডুবুক, সর্বনাশ হয় তো হোক।
সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া—এই সাতটি জেলায় ছড়িয়ে রয়েছে বিস্তীর্ণ হাওরাঞ্চল। এসব এলাকার লাখ লাখ কৃষক ও হাজার হাজার কোটি টাকার ফসলের চেয়ে কিছু ঠিকাদার কিংবা প্রকৌশলী-কর্মকর্তার স্বার্থ বড় হতে পারে না। আমরা চাই, হাওরাঞ্চলের বাঁধসংক্রান্ত সব প্রকল্পের কাজ দ্রুত শুরু করা হোক। একই সঙ্গে প্রকল্পের কাজ শুরুর ক্ষেত্রে এমন বিলম্বের কারণ অনুসন্ধান করা হোক।
পুরো বাংলাদেশের যে ইকোসিস্টেম, সেখানে হাওর অঞ্চলটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে উন্নয়নের সুযোগ আছে। কৃষিপণ্যের উৎপাদন বাড়ানোর সুযোগ আছে। তাই হাওরের সমস্যার দ্রুত ও টেকসই সমাধান জরুরি।

Check out our other content

Check out other tags:

Most Popular Articles