লাখো শহীদের রক্ত ও মা বোনের সম্ভ্রম হানির মাধ্যমে পেয়েছি মহান স্বাধীনতা । ২৬ শে মার্চ, আমাদের মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। আমাদের গৌরব ও অহঙ্কারের দিন । বিশ্বের বুকে মাথা উচু করে দাঁড়াবার দিন । লাল-সবুজের নিশান ওড়ানোর দিন।পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙ্গার জন্য ইতিহাসের পাতা রক্তে রজ্ঞিত করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এদেশের জনতা।একাত্তরের দিনগুলিতে যে সংগ্রাম ও দূর্ভোগ ছিল , অদম্য সাহস ও আত্মত্যাগের অতুলনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন ছিল চূড়ান্ত পরিণতি। আজ এই জাতির ৫১তম স্বাধীনতা দিবস পেতে হাজার হাজার বছরের ইতিহাসের পাতা পাড়ি দিতে হয়েছে । বাঙালি জাতি আজীবন বহিরাগত জাতি দ্বারা শোষিত ও শাসিত হয়েছে । সেই মৌর্য-গুপ্ত যুগ থেকে শুরু করে মুঘল শাসন,পশ্চিমা বেনিয়া জাতিদের আগমন এবং সর্বশেষ পাকিস্থানিদের দ্বারা শোষিত হয়ে অবশেষে এ জাতি আজ স্বাধীন ।
১৭৫৭ সালে মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতার ফলে পলাশীর প্রান্তরে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়। ফলে বাংলার ইতিহাসে দীর্ঘ ১৯০ বছরের এক অন্ধকার অধ্যায় রচিত হয়।অবশেষে ১৯৪৭ সালে ১৪ ও ১৫ আগস্ট পাকিস্তানও ভারত নামক দুটি রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। অনেক আশা প্রত্যাশা নিয়ে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পৃথিবীতে এক আজগুবি মানচিত্রের জন্ম হয়।বর্তমান বাংলাদেশ পূর্ব বাংলা নামে শুধুমাত্র ধর্মের মিল রেখে পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে নতুন রাষ্ট্র গঠন করে । বাংলার খেটে খাওয়া জনগনের ধারণা ছিল প্রায় ২০০ বছর পর স্বাধীন হয়েছে, হয়তো শোষণ নির্যাতনের দিনের অবসান হবে ।কিন্তু সেটা বাঙালিদের একপ্রকার স্বপ্নই ছিল ,বাস্তব রুপে কখনো ধরা দেয়নি। এ যেন খাল কেটে কুমির আনা ।পুরাতন উপনিবেশের জাতাকল থেকে মুক্তি পেতে না পেতে নতুন করে উপনিবেশ শুরু ।
পরর্বতী ২৩ বছরের ইতিহাসে বাংলার রাজপথ থেকে কখনো রক্তের দাগ শুকাতে পারেনি ।দেশ বিভাগের পরে প্রথম আক্রমণ ছিল রাষ্ট্র ভাষার উপর। শাসক গোষ্ঠি কোন প্রকার বিবেচনা ছাড়া মাত্র ৬% মানুষের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা করার তালে মেতে উঠে। ফলে ৫৬% বাংলা ভাষাভাষী জনগন ফুসে ওঠে ।দীর্ঘ কয়েক বছরের ছোট বড় আন্দোলন পরে ১৯৫২সালে ভাষা আন্দোলন চুড়ান্ত রুপ ধারণ করে ।সালাম বরকতদের রক্ত দানের মাধ্যমে পৃথিবীর প্রথম কোন জাতি হিসেবে ভাষার জন্য প্রাণ দিয়ে গৌরবময় ইতিহাস রচনা করে ।অবশেষে অদম্য বাঙালিদের কাছে শাসক গোষ্ঠি নতি স্বীকার করে ১৫৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধানে উর্দুর পাশাপাশি রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে বাংলা কে স্বীকৃতি দেয়। সফল ভাষা আন্দোলনের পরে আঘাত আসে ১৯৫৪ সালে ।
৫৪সালের নির্বাচন ছিল বাঙালিদের জন্য এক মাইল ফলক। ৪টি রাজনৈতিক দল নিয়ে গঠিত যুক্তফ্রন্ট দলটি নির্বাচনে একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করার পরও মাত্র ৫৬ দিনের মাথায় পাকিস্তানি শা্সকগোষ্ঠির আঘাত আসে । ফলে জয়ী হলেও সরকার গঠন করতে পারলো না ।এর পর ’৫৬ সালে বৈষম্যমুলক সংবিধান প্রণয়ন হল। পাকিস্তানের প্রথম প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা’৫৮সালে মার্শাল ’ল জারি করে আইয়ুব খানকে প্রধান সামরিক শাসনকর্তা নিয়োগ দেন । আইয়ুব খান সেনা প্রধান হতে না হতেই প্রসিডেন্টকে হটিয়ে নিজেকে পাকিস্তানের স্বনির্বাচিত প্রসিডেন্ট ঘোষনা দেন। এবং নিজের ক্ষমতা আজিবন ধরে রাখতে মৌলিক গণতন্ত্র নামে নতুন প্রহসন শুরু করে ছিলেন ।পশ্চিম পাকিস্তানিরা যে ক্ষমতা লোভি ছিল, এটি তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ ।
এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানে শোষণের নতুন মাত্রা যোগ হয়।অতপর ’৬২-এর শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলনের পরে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ৬ দফা। বাঙালির ম্যাগনাকার্টা ও মুক্তির সনদ ১৯৬৬ সালে ঘোষণা করেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ।বাঙালির বাচার অধিকার এ দাবিতে স্বায়ত্তশাসন , কর ,ব্যবসা -বাণিজ্য ,ভিন্ন মুদ্রা ও আধা সামরিক বাহিনি গঠনের কথা উল্লেখ করেছেন । বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ পেতে ৬দফা ছিল এক অদম্য অ্ণুপ্রেরণা। তৎকালীন নায়ক বনে যাওয়া বাঙালির মুক্তির প্রতিক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন । এবং বাংলার জনগনের জন্য ত্রাণকর্তা হয়ে দাড়ান ।পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠি অবস্থা উপলদ্ধি করতে পেরে ১৯৬৮ সালে আগরতলা মিথ্যা মামলা জারি করেন। মামলায় বঙ্গবন্ধুকে ১নং আসামি করার পাশাপাশি শীর্ষ স্থানীয় আরো ৩৪ জন নেতার নামে মিথ্যা মামলা জারি করা হয় ।
শাসকগোষ্ঠির ধারণা করেছিল মিথ্যা মামলা দ্বারা বাংলার জনগন থেমে যাবে ।কিন্তু তাদের সকল চিন্তা ভাবনা কে ভুল প্রমাণ করে বাঙালি জনগন রাজপথে নেমে আসে। ১৯৬৯ সালে আরেক কালো সাক্ষীর মুখোমুখি হয় বাংলার ইতিহাসের পাতা।সার্জেন্ট জুহুরুল হক , রাবির শিক্ষক শামসুজ্জোহা ,ঢাবি ছাত্র আসাদ ছাড়াও কাল থাবা থেকে রক্ষা পারনি নবকুমার স্কুলের ছাত্র মতিউর । অবশেষে উত্তাল জনগের তোপে পড়ে আইয়ুব খানের পতন ও ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতে বাদ্য হন । এর পরের দিনে তৎকালিন ডাকসুর ভিপি তোফায়েল আহমেদ জনগনের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবর রহমান বঙ্গবন্ধু উপাধি দেন। আইয়ুব খানের পতনের পরে ক্ষমতায় আসেন ইয়াহিয়া খান এবং তিনি ক্ষমতায় এসেই সকলকে আশার বাণী শোনান এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দেন । অবশেষে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল এবং আওয়ামী লীগ একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করে ।এরপরই প্রসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের আসল রুপ বেড়িয়ে আসতে থাকে ।
ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে তালবাহানা শুরু করে।জয়ী সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তের পরির্বতে ১লা মার্চ ইয়াহিয়া খান জাতিয় পরিষদে অধিবেশন অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ করে দেন ।প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু দেশব্যাপি অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন।ফলে বাংলার জনগন রাজপথে নেমে আসে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। ৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধুর আহবানে লাক্ষ লাক্ষ জনতা জমা হয় রেসকোর্স ময়দানে ।অবিসংবাদিত নেতার ডাকে সাড়া দিয়ে বাঙালি জনতা ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলে ।বঙ্গবন্ধুর ডাকে পাকিস্তানকে পূর্ণাঙ্গ অসহযোগিতা করা শুরু করে । এদিকে শাসক গোষ্ঠি আড়ালে ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে থাকে ।তারই অংশ হিসেবে ১৬ মার্চ ইয়াহিয়া খান সমঝোতা নামে কাল ক্ষেপন বৈঠক করে ,যাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা গণহত্যার জন্য প্রস্তুত হতে পারে ।১৮ মার্চে বাঙালি নিধন নামে অপারেশন সার্চ লাইট পরিকল্পনা তৈরি করেন টিক্কা খান ও রাওফরমান ।বাঙ্গালিকে কাপুরুষের মত আক্রমন করতে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বাহিনিকে নিরস্থ করা শুরু করে ।
বাঙালি জনতা প্রতিবাদ স্বরূপ ২৩ মার্চ পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্রের দিবসে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উত্তোলন করেন ।এদিকে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে আসা শাষক গোষ্ঠি তাদের উদ্দেশ্য সামরিক জান্তাকে বুঝিয়ে ২৫মার্চ রাতে পাকিস্থান ফিরে যান। টিক্কা খান বলেন, এদেশ মানুষ চাইনা ,মাটি চাই । ফলে সৈন্যরা পোড়ামাটির নীতি নিয়ে গণহত্যায় নেমে পড়েন । মধ্যরাতে বাঙালি নিধন সংকেত নামে অপারেশন সার্চ লাইট পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে সেনাদল রাজপথে নেমে আসে ।সেনা দল প্রথমে ঢাকা ক্যান্টমেন্ট তারপর রাজারবাগ পুলিশ লাইন,বিডিয়ার পিলখানা এবং রক্ষা পাননি ঢাবির শিক্ষার্থীরা । সেই কালো রাতে এক মৃত্যুপূরিতে পরিণত হয়।গ্রেপ্তার হন বাংলা অবিসাংবাদিত নেতা । গ্রেপ্তার হবার আগে তিনি ওয়ারলেসের মাধ্যমে স্বাধিণতা ঘোষণা দিয়ে যান। বলেন,এটাই হয়ত আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন………।
পরে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা সংক্রান্ত বিবৃতিটি সর্বপ্রথম পাঠ করেন আওয়ামী লীগ নেতা এমএ হান্নান। এরপর ২৭ মার্চ তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে দ্বিতীয়বারের মতো স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে যে ঘোষণা পাঠ করা হয় সেখানে উল্লেখ ছিল `…ডিক্লেয়ার দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্স অব বাংলাদেশ অন বিহাফ অব আওয়ার গ্রেট ন্যাশনাল লিডার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।জাতির পিতার আহবানে সাড়া দিয়ে বাংলার মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ সর্বস্তরের জনগণ জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধভাবে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী গৌরবোজ্জ্বল সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ ও দুই লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে বাংলার জনগণ অর্জন করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
এই স্বাধীনতা বাঙ্গালির জন্য অনিবার্য ছিল । কেননা বাঙ্গালিরা প্রতি ক্ষেত্রে নিষ্পেষিত ছিল । আইয়ুব খান তার শাসন আমলে ১৯৫৮-৬৮ সাল পর্যন্ত উন্নয়ের দশক ঘোষনা দিলেও পূর্ব পাকিস্থানে ছিল বিপরীত চিত্র। এই আমলে পূর্ব পাকিস্তানে শিক্ষা , চিকিৎসা অবকাঠানো ,প্রাশসনিক সকল ক্ষেত্রে ছিল বৈষম্যের চিত্র । আসল উন্নয়ন হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। তারা বাঙ্গালিদের প্রদেয় কর শুল্ক দিয়ে নিজেদের উন্নয়ে ব্যয় করেছিল।এই অবিচারের বিরুদ্ধে বাঙ্গালির অবিসাংবাদিত নেতা আগুনের মত জ্বলে ওঠে । অন্যায়-অবিচারের প্রতি প্রতিবাদ করতে গিয়ে পাকিস্তানি শাসনামলে দীর্ঘ ১৪ বছরেরও বেশি সময় কারাগারের অভ্যন্তরে থাকা, কয়েকবার ফাঁসির কাষ্টের মুখোমুখি, নিজের চোখের সামনে নিজের কবর খুরতে দেখা, অসংখ্য মিথ্যা মামলায় অসংখ্যবার কারাবরণ করার পরও এদেশের স্বাধিকার আন্দোলনে প্রেরণা দিয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
৫ ফুট ৮ ইঞ্চি এই মানুষটার পা থেকে মাথা পর্যন্ত পুরো শরীর জুরে কলিজা কারণ তার অপরিসীম সাহস, দৃঢ়চেতা মনোভাব ও আপোষহীন নেতৃত্ব পরাধীন বাঙালি জাতিকে সংগ্রামী হওয়ার প্রেরণা জুগিয়েছিল। তাঁর দূরদর্শী নেতৃত্বের কল্যাণে আজ আমরা স্বাধীন । বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে এক ভুখন্ড তৈরি হয়েছে । কথায় আছে স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন । স্বাধীনতার ৫১তম বছরে এসেও আমরা সম্পূর্ণ রুপে স্বাধীন হতে পারিনি । অন্যায় ,দুর্নীতি ,ধর্ষন , মিথ্যাচারে এখনো আমরা জরিয়ে আছি । অন্যায় দুর্নীতির লজ্জাজন অবস্থান থেকে বেড় হতে না পারলে এদেশ কখনো বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা হতে পারবেনা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে সঠিক ভাবে ধারন করতে পারলে সোনার বাংলা গড়া সম্ভব। নানা প্রতিকুলতা সত্ত্বেয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের সঠিক দিকনির্দেশনায় বাংলাদেশ এখন উন্নত দেশে পরিণত হবার পথে।
শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়