বরেণ্য বুদ্ধিজীবী ও সমাজতান্ত্রিক চিন্তাবিদ, লেখক, গবেষক, ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ৮৭তম জন্মদিন উপলক্ষে বৃহস্পতিবার (২৩ জুন) বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে একক আত্মজৈবনিক বক্তৃতা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
- Advertisement -
সেখানে জীবনের শুরু থেকে এ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া নানা দিক আলোচনার পাশাপাশি টানা তিনবার সিনেটে ভিসি প্যানেল নির্বাচনে জয়ী হয়ে এবং প্রস্তাব পেয়েও কেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর (ভিসি) হননি সে গল্পও শোনান অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।
- Advertisement -
স্মৃতি বক্তৃতায় সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাকে বহু পদে সিনেটে, সিন্ডিকেটে, ডিন পদে নির্বাচনে দাঁড়াতে হয়েছে। আমি সিনেটে চারবার দাঁড়িয়েছি, প্রথমবার আমি পারলাম না, বাকি তিনবার আমি নির্বাচিত হয়েছি। দ্বিতীয়বার আমি সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছিলাম, রটে গিয়েছিল, আমিই ভাইস চ্যান্সেলর হব। এরশাদ যখন ক্ষমতায় আসছেন, তখন ধারণা করা হচ্ছিল তিনি আওয়ামী লীগের বিরোধীকে নেবেন। আমি ভয় পেয়ে গেলাম এরশাদের অধীনে আমাকে ভাইস চ্যান্সেলর হতে হবে।
- Advertisement -
জিয়াউদ্দিন বাবলু আমাদের ছাত্র, সে একটা অত্যন্ত খারাপ কাজ করেছিল। আমি তখন ডাকসুর ট্রেজারার, সে তখন ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক হয়ে এরশাদের দলে যোগ দিল। কোনো ইতিহাসে নেই ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক থাকা অবস্থায় সরকারি দলে যোগ দিয়েছে। জিয়া উদ্দিন বাবলু আমাকে ফোন দিয়েছি বলেছিল স্যার আপনার জন্য আমি এরশাদ সাহেবের কাছে সুপারিশ করব। আমি তাৎক্ষণিকভাবে বলেছি, তুমি যদি আমার ছাত্র হও, আমার জন্য কোনো তদবির করো না।
- Advertisement -
তিনি বলেন, ভিসি হব এই কথা রটে যাওয়ায় অনেক লোক বাসায় আসা শুরু করল, আমি ভয় পেয়ে গেলাম, তাদের সকলের আগ্রহ তো আমি মেটাতে পারব না। একে তো সামরিক শাসন, তারপর এ ধরনের আকাঙ্ক্ষা। আমি ডিন হয়েছিলাম এর আগে। ডিন হয়ে বুঝে ফেলেছি এ আমার কাজ না। কেননা ডিনের কাছে অনেক সুপারিশ আসে। নানা ধরনের প্রমোশন, নিয়োগের সুপারিশ নিয়ে সবাই আসতেন। যার কারণে আমি বাসায় থাকতাম। কিন্তু তখন বিচ্ছিন্ন মনে হতো। মনে হতো ভিসি হলে আমি এ বিচ্ছিন্নতা মেনে নিতে পারব না।
- Advertisement -
তিনি আরও বলেন, আমার স্ত্রীর পরামর্শ চেয়েছিলাম, তুমি কী মনে কর? সে চিন্তা করল আমি ভিসি হলে বড় বাড়িতে চলে যাব, সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাব, আবার যখন ফিরে আসব তখন তারা কীভাবে দেখবে। তখন নাজমা আমাকে ছোট করে বলেছিল, আমি লেকচারারকে বিয়ে করেছি, তখন আমি বুঝলাম।
- Advertisement -
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, অনেকে বলে আমি খুব ভীতু, ভয় পেয়ে গেছি, আবার কেউ কেউ বলেছেন, এমন দরজা নেই, যেখানে গিয়ে ধাক্কা দিইনি ক্ষমতার জন্য। আবার কেউ কেউ বলেছেন এরা গবেষণা করে না, দলবাজি করে বেড়ায়। এটা কিন্তু আমাদের সামাজিকতা শিখিয়েছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষকের কাছে আমরা যেতাম ভোটের জন্য। কার্জন হলে গিয়েছি, সেখানে একজন শিক্ষক বললেন আমরা তো ভাই গবেষণা করি। ভাবটা এই, আমরা শুধু দলাদলি করি, উনারা গবেষণা করেন। আমরা গবেষণাও করি, দলবাজিও করি। দলবাজি করতাম এজন্য যে, আমরা স্বায়ত্তশাসন চাই, আমরা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চাই।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটে চারবার উপাচার্য নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তিনবার উপাচার্য প্যানেলে নির্বাচিত হন। তিনি বলেন, প্রথমবার আমি পারলাম না, বাকি তিনবার আমি সিনেটে নির্বাচিত হয়েছি। দ্বিতীয়বার আমি সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছিলাম, রটে গিয়েছিল আমিই ভাইস চ্যান্সেলর হব। এরশাদ যখন ক্ষমতায় আসছেন, তখন ধারণা করা হচ্ছে, তিনি আওয়ামী লীগ বিরোধীকে নেবেন। কিন্তু আমি এরশাদ সাহেবকে সরাসরি না করে দিলাম।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, এরশাদ আমাদের তিন জনের সাক্ষাৎকার নিলেন, আমি না করে দিলাম আমি হব না। এরশাদ সাহেব বললেন তাহলে দাঁড়ালেন কেন? আমি দাঁড়িয়েছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করার জন্য, স্বায়ত্তশাসনের অনুশীলনের জন্য। একটা ভিন্ন কণ্ঠ যাতে থাকে, সেজন্য। তিনি বেশ খুশি হয়ে আমাকের বিদায় করে দিলেন। এরপর দুবার আমি যে নির্বাচিত হয়েছি, সেটা ছিল ডামি ক্যান্ডিডেট, আমি হব না। কিন্তু তিনজন লাগে। একবার হলেন মনিরুজ্জামান মিঞা, সেইবারও আমি প্যানেলে নির্বাচিত হলাম, আবার হলেন এমাজউদ্দিন আহমদ, সেবারও আমি প্যানেলে নির্বাচিত হলাম।
তিনি বলেন, ইয়াজউদ্দিন সাহেব আমাদের শিক্ষক সমিতির সভাপতি ছিলেন, তিনি অ্যাডভাইজার হয়ে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পেলেন। তিনি আমাকে বললেন আমার বড় শখ, আপনাকে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হতে হবে। আমি বললাম আমি তো হব না। এটা আমার কাজ না। মন্ত্রণালয় থেকে ঠিক করা হয়েছিল, আমাকে ইউজিসির চেয়ারম্যান করা হবে। সেটাতেও আমি রাজি হইনি।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে দল করতাম, এটা আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে। আমাকে সব নির্বাচনে দাঁড়াতে হত। কেননা, আপনারা ভাবতে পারবেন না আইয়ুব খানের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন কীরকম ছিল। তার বিরুদ্ধে ছাত্ররা ১১ দফা দিয়েছে, আওয়ামী লীগ তার বিরুদ্ধে বলেছে, বাংলাদেশ স্বাধীন না হলে ওই আইন বাতিল হতো না। স্বাধীনতার পরেও ওই আইন বাতিল হচ্ছিল না, নতুন আইন আসছিল না। আমরা আন্দোলন করে আইন এনেছি। গণতান্ত্রিক বিধি চালু হয়েছে। সেখানে নির্বাচন আছে।
স্বাধীনতার পরে আমরা যখন দেখলাম, যাদের আমরা প্রতিক্রিয়াশীল বলতাম, তারা তো শেষ হয়ে গেছে। যারা আমরা প্রগতিশীল ছিলাম, তারা দুভাগ হয়ে গেছি। এক দল চলে গেছে প্রশাসনের পক্ষে। আমাদেরকে দাঁড়াতে হয়েছে গণতন্ত্রের পক্ষে। আমরা স্বায়ত্তশাসনকে কার্যকর করতে চেয়েছি। আমরা একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে উদাহরণ সৃষ্টি করতে চেয়েছি, কেমন করে বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতন্ত্রের অনুশীলন চলে। সে কারণে আমাদের আলাদা দল করতে হয়েছে।