31 C
Bangladesh
শনিবার, জুলাই ২৭, ২০২৪

”শিক্ষকতা জীবনের তিরিশ বছর” নিয়ে লিখেছেন রাবি শিক্ষক

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়''শিক্ষকতা জীবনের তিরিশ বছর'' নিয়ে লিখেছেন রাবি শিক্ষক

আজ আমার শিক্ষকতা জীবনের ৩০বছর পূর্ণ হল। ১ লা জুলাই, ১৯৯২- এই দিনটির কথা এখনও খুব মনে পড়ে। সকাল ৮-১৫। দুরু দুরু বক্ষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বিজ্ঞান ভবনের ৩৩৩ নম্বর কক্ষে প্রবেশ করলাম, B. Stat. 101: Probability Theory কোর্সটি পড়াবার জন্য। ঘটনা চক্রে সেটি ছিল সেই বছর প্রথম বর্ষ সম্মান শ্রেণীর প্রথম ক্লাস। আমার হাত দিয়েই উদ্বোধন হল সেই বছরের শিক্ষা কার্যক্রম। বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা প্রফেসর খোন্দকার মনোয়ার হোসেন স্বয়ং এই কোর্সটি আমার জন্য নির্ধারণ করেছিলেন। কিন্তু কেন?

 

এভাবেই শিক্ষাকতা জীবনের তিরিশ বছর দিয়ে শুরু করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রহমতুল্লাহ ইমন, পরিসংখ্যান বিভাগ। রাবি শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত ফেসবুক গ্রুপ ”রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার” থেকে লেখাটি তুলে ধরা হলো – 

 

কারণটা ছিল সত্যি আতংকের কেননা ছাত্রজীবনে আমি এই কোর্সটিতে ভাল করতে পারি নি। বিভাগীয় শিক্ষা কমিটির সভায় স্যার আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘তুই তো প্রবাবিলিটির কিছুই জানস না, এখন দ্যাখ পড়াইতে গিয়া যদি কিছু শিখবার পারস।‘ কেন বুক দুরু দুরু করছিল এবার আপনারা নিশ্চয় তা অনুধাবন করতে পারছেন। আর প্রথম যে কোন অভিজ্ঞতাই তো আবেগ, উত্তেজনা, ভালোলাগা আর উৎকণ্ঠায় ভরপুর অনুভূতির সমাহার। তবে নিয়তির কী নির্মম পরিহাস, সেই থেকে প্রথম বর্ষে এই কোর্সটি আমার জন্য চির নির্ধারিত হয়ে গেল। রাবি’র পরিসংখ্যান বিভাগে যত বছর শিক্ষকতা করেছি প্রতিবছরই এই কোর্সটি পড়াতে হয়েছে।

 

সত্যি কথা বলতে প্রথমদিনের ক্লাসে বেশ নার্ভাসই ছিলাম। অবশ্য এটা আমি বিলক্ষ্মণ জানতাম যে আমার মত ইডিয়টেরা অতি আত্মবিশ্বাসী হয় কেননা তাদের হারাবার কিছু নেই। কিন্তু গোল বাধল তখনই যখন দেখলাম আমার মেঝ ভাই রবিন ক্লাসে ঢুকে বসে আছে। রবিন সে বছরেই ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হয়েছে, কিন্তু ঠিক ঐ সময়ে নিজের ক্লাস না থাকায় চলে এসেছে আমার ক্লাসে। উদ্দেশ্য খুব পরিষ্কার। ক্লাসে আমার দুর্দশা দেখবে আর বাসায় গিয়ে তা সবার কাছে রসিয়ে রসিয়ে গল্প করবে। ক্লাসের কেউ জানতই না যে সে আমার ভাই। লক্ষ করলাম সে একে ওকে খোঁচাচ্ছে। আমার কানে এল আমার প্রিয় ছাত্র নাসিম (ড নাসিম মাহমুদ) এর পাশে বসে আস্তে আস্তে সে বলছে, ‘দেখে মনে হচ্ছে যে স্যারটা একদম ভুয়া’ নাসিম সজোরে মাথা নেড়ে প্রতিবাদ করে বলছে, ‘আপানার কোন ধারণা আছে এই স্যার সম্পর্কে? উনার সম্পর্কে আমি কত গল্প শুনেছি এখানে ভর্তি হবার আগে। এ যাবত উনার মত এত ভাল ছাত্র আমাদের বিভাগে খুব কম এসেছে। উনি শিক্ষক হিসাবেও খুব ভাল হবেন আমার বিশ্বাস‘। ওদের কথোপকথনে আমি নিজেও খানিকটা বিস্মিত এবং আতংকিতও হলাম। নাসিম যা বলছে তা একদমই ঠিক নয়, আমি খুব সাধারণ মানের একজন ছাত্র। কিন্তু সেই প্রথম দিন থকেই কিভাবে জানি আমাকে ঘিরে কিছু মিথ তৈরি হয়েছে। ছাত্রদের এই অতি প্রত্যাশার চাপ আমি সইতে পারব তো? জীবনে প্রথম লেকচার দেবার আগেই ছাত্ররা আমার সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে শুরু করে দিয়েছে।

 

ক্লাস শেষ হল। মনে হল সেদিন সে যাত্রায় রক্ষা পেলাম। রবিনের মুখের হাসি অনেক চওড়া হল। আমাকে বল, ‘দাদা, আপনার দুর্দশা দেখতে গিয়েছিলাম, কিন্তু ক্লাস শেষে আপনার ছাত্ররা যেভাবে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠল তাতে মনে হল আমার উচ্চতা হয়ে গেছে ১০ ফুট’। মনোয়ার স্যার নিজেও নিয়মিত খোঁজ রাখতেন আমি কী পড়াচ্ছি, কেমন পড়াচ্ছি এই বিষয়গুলো। ক্রমেই ক্লাসের চাপ বাড়তে শুরু করল। যখন যে কোর্স ফাঁকা হয়, সঙ্গে সঙ্গেই তা আমার ওপর চাপিয়ে দেওয়া শুরু হয়। এক পর্যায়ে ক্লাস লোড গিয়ে ঠেকল সপ্তাহে ৩০ ঘন্টা। তখন সেশন জটের কারণে বিভাগে অনেকগুলো ব্যাচের ক্লাস একসাথে চলছে। প্রথম বর্ষ (নতুন এবং পুরাতন) এ : Probability Theory, দ্বিতীয় বর্ষে Bivariate Distributions and Systems of Frequency Curves (এখনকার ছাত্ররা হয়তো এই কোর্সের নামও শোনেনি), তৃতীয় বর্ষ (নতুন) এ Stochastic Processes, তৃতীয় বর্ষ (পুরাতন) এ Regression Analysis, মাস্টার্সে Order Statistics আর সেই সাথে ব্যবহারিক ক্লাস তো আছেই। আজ যখন পেছন ফিরে তাকাই তখন নিজেই বিস্ময়ে অভিভূত হই কিভাবে এই পাহাড়সম ক্লাসের চাপ আমি তখন সামাল দিতাম। জানি আমি ভাল শিক্ষক নই আর তাই তা নিয়ে গর্ব করার কিছু নেই, তবে আমার একটা বিষয়ে ভীষণ গর্ব আছে আর তা হল আমি জ্ঞানত জীবনে কখনোও একটি ক্লাসও মিস করি নি, এমনকি যেদিন আমার বাবা পৃথিবী থেকে চির বিদায় নিয়ে চলে যান সেদিনও নয়। প্রতিদিন ভোর সাড়ে ৭ টা থেকে ৮ টার মধ্যে বিভাগে পৌঁছে যেতাম, কোনদিন এমন হয়নি যে অফিসের কোন পিওন আমার আগে যেয়ে ক্লাসরুম খুলেছে আর বাসায় ফিরতাম রাত ৯ টার পর। অনেক ছাত্রই রাত ৮ টা বা ৯ টার পর বিভাগে আমার সাথে দেখা করতে যেত, কেননা তারা জানত আমি ঠিকই আছি সেখানে। আমার অন্য সেসব বন্ধু সহপাঠী অন্য বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন তারা আমার দুর্ভাগ্য নিয়ে রীতিমত ঠাট্টা মশকরা করত। আমাকে বলত তোকে দেখে মনে হয় ভাবখানা এমন যেন আর কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার হয় না! কিন্ত তাদের কি করে বোঝাই যে আমি জ্ঞান বুদ্ধিতে অনেক পিছিয়ে থাকা একজন মাস্টার। তারা সব কিছু শিখে মাস্টার হয়েছে আর আমি মাস্টার হবার পর সবে শিখতে শুরু করেছি। আর মনোয়ার স্যার আমার প্রতি মুহূর্তের গতি প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করছেন।

আরো পড়ুন:  বহিষ্কারের পর এবার গ্রেফতার শিক্ষিকাকে লাঞ্ছনাকারী সেই আশিক 

 

আমার যাত্রা শুরুর পেছনের গল্পটিও কম কৌতুহলোদ্দীপক নয়। সম্ভবত দিনটি ছিল মে মাসের ২৯, সাল সেই ১৯৯২, তবে সেদিন যে ছিল শুক্রবার এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিসংখ্যান বিষয়ে এম এসসি পাস করেছি মাস তিনেক। ততদিনে বাবা অবসরে চলে গেছেন, শুধু তাই নয়, তিনি গুরুতর অসুস্থ- প্রাণ সংশয় বলতে যা বোঝায় তাই। ঘরে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া দুই ভাই, বোনটা স্কুলে। দারিদ্র্যের কষাঘাত কাকে বলে তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। সমানে প্রাইভেট পড়াচ্ছি। পরিসংখ্যানের কদর সর্বত্র- তাই পড়ুয়াদের ভিড় লেগেই আছে। কিন্তু বাবার কড়া নির্দেশ- কারো কাছ থেকেই পয়সা নেওয়া যাবেনা। প্রাইভেট পড়িয়ে পয়সা নেবার মাঝে আমি তেমন একটা দোষ দেখিনা, আমি তো বাড়তি কাজ করছি, তার বিনিময়ে পয়সা পাচ্ছি। কিন্তু বাবার ভাবনা ছিল আলাদা। তিনি যেসব শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়েছেন, তাঁরা এর বিনিময়ে অর্থ তো নেনই নি, উপরন্তু তাঁকে বাসায় রেখেছেন, খাওয়া পরার ব্যবস্থাও করে দিয়েছেন। বাবা বলতেন, আমার শিক্ষকেরা যদি পড়ানোর জন্য অর্থ দাবি করতেন তাহলে আমার আর লেখাপড়া শেখা হতনা। বাবার অনুভূতিগুলোকে আমি সবসময়ই সম্মান করে এসেছি, তাই প্রচুর নগদ অর্থ উপার্জনের সুযোগ থাকা সত্বেও তার জন্য লালায়িত হইনি। ততদিনে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি। ছাত্র যেমনই হই না কেন, ফলাফল যা হয়েছে তাতে আমাকে উপেক্ষা করা খুব সহজ ব্যাপার নয়। কিন্তু কবে পদ বিজ্ঞপ্তি হবে, নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু এবং শেষ হবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। বাবার খুব ইচ্ছা ছিল আমি যেন বিসিএস পরীক্ষা দেই। বরাবরই আমার সাধারণ জ্ঞানটা ভাল ছিল, বাবার বিশ্বাস ছিল পরীক্ষা দিলেই আমি বিসিএসে প্রথম হব। কত সব ছেলেমানুষি ভাবনা।

আরো পড়ুন:  ফেসবুক লাইভে এসে জাককানইবির শিক্ষার্থীর আত্নহত্যার চেষ্টা, শিক্ষক বলছে আত্নপরিচয় কি

 

একটা বিসিএস গাইড কিনে পড়া শুরু করেছি মাত্র। এর মাঝে একজন আত্মীয়ের মাধ্যমে হঠাৎ করেই সিরাজগঞ্জে একটি এনজিওতে চাকরির আমন্ত্রণ পেলাম। ভালো বেতন, না করার মত অবস্থা নেই আমার। এম এসসি পাস করে যাবার পরেও বাবা মা’র কাছ থেকে হাত পেতে টাকা নিতে কেমন লাগে, যাদের এই অভিজ্ঞতা হয়নি তাদের এটা বোঝানো যাবেনা। সেদিন শুক্রবার, পরদিনই সিরাজগঞ্জ যেতে হবে। যাবার প্রস্তুতি হিসেবে সকালে কাজলা বাজারে গিয়েছি টুকিটাকি কিছু প্রয়োজনীয় কেনাকাটা সারতে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সবতো বাড়িতে থেকেই, বাইরে থাকার কোন অভিজ্ঞতা নেই। কিছুটা উদ্বিগ্ন, কিন্তু তার থেকে অনেক বেশি রোমাঞ্চিত। একটু অন্যমনস্কই ছিলাম বোধ হয়। আচমকা মনোয়ার স্যারের কথায় সম্বিৎ ফিরল। দেখা হতেই স্বভাবসুলভ বক্রোক্তি করলেন,

 

”সাত সকালে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়াচ্ছিস? আজকাল কী কইরা খাস?”

 

‘What do you do for living?’ এই বাক্যের এত সুন্দর বাংলা তর্জমা ‘আজকাল কী কইরা খাস?’ স্যারের মুখ ছাড়া আর কোথাও শুনেছি বলে মনে পড়েনা।

বললাম, ”স্যার কাল সিরাজগঞ্জ যাচ্ছি।”

” কেন?”

 

”চাকরির ব্যাপারে, একটা এন জি ও তে।”

একগাদা মানুষের সামনে স্যার পারেন তো আমাকে মারেন। ক্রোধে অগ্নিশর্মা।

“তোরে লেখাপড়া শিখাইসি এন জি ও তে চাকরি করার জন্য?”

 

আমি কোন চাকরিকেই ছোট করে দেখিনা, দেশে কত ভাল এন জি ও নিরলসভাবে কাজ করে চলেছে। কিন্তু আমাকে নিয়ে স্যারের হয়তো অন্যরকম স্বপ্ন ছিল, আর সেজন্যই আমার এই সিদ্ধান্তে এতটা রুষ্ট হয়েছিলেন। যারা মনোয়ার স্যারকে চেনেন তাঁদের কাছে স্যারের পরিচয় দেওয়া বাতুলতা মাত্র। আর যারা তাঁকে চেনেন না হাজার লক্ষ পাতা লিখেও তাঁর স্বরূপ বোঝানো আমার মত মানুষের পক্ষে অসম্ভব। তিনি পরিসংখ্যান বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা, কেমব্রিজে প্রফেসর স্যার মরিস কেন্ডালের ছাত্র এসব পরিচয় কিছুই নয় তাঁর প্রবল ব্যক্তিত্বকে অনুধাবন করার জন্য। তিনি যেন আমাদের বিভাগকে ওন করতেন একজন জন্মদাতা পিতার মত- সেখানে তাঁর কথাই শেষ কথা। স্যার ছিলেন আমাদের কাছে মূর্তিমান এক আতংক।

 

স্যার যে পথ দিয়ে হাঁটতেন আমরা পালিয়ে অন্যপথে যেতাম যেন তাঁর মুখোমুখি পড়তে না হয়। আবার তাঁর কোমল হৃদয়ের পরিচয় অনেক পেয়েছি। কোন ছাত্র অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছে শুনলে তিনিই সবার আগে ছুটে গিয়েছেন তার খোঁজ নিতে, তার চিকিৎসার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। কঠোরতা আর কোমলতার এক অপূর্ব সমন্বয় ছিল তাঁর মাঝে। যাই হোক এর পরের অংশটি আমার জন্য ইতিহাস। স্যার বাসায় ফিরে বিভাগের সব সিনিয়র শিক্ষকদের সাথে আলাপ সেরে উপাচার্য মহোদয়ের কাছে আমার জন্য চাকরি দাবি করলেন। উপাচার্য মহোদয় প্রফেসর আমানুল্লাহ আহমদ তাঁর মেয়াদকালে একটিও এডহক নিয়োগ দেননি। কিন্তু স্যারের অনুরোধ তিনি উপেক্ষা করতে পারলেন না। তাঁর চার বছরের মেয়াদকালে এটিই ছিল একমাত্র এডহক নিয়োগ। তখন গ্রীষ্মাবকাশ চলছে- তাই আমার নিয়োগের দিন ধার্য হল ১লা জুলাই, ১৯৯২।

আরো পড়ুন:  রাবিতে মোঃ নাঈম ইসলামের শো ডাউন

 

এরপর একে একে কেটে গেল তিরিশটা বছর। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা জীবন ২০ বছরের, বল স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৫ বছর, বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ বছর, পুত্রা মালয়েশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ বছর ৪ মাস, মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬ মাস এবং কায়রোর আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬ মাস। ৩০ বছরের হিসাব মিলল কি? না, কেননা অনেক ওভারল্যাপ আছে। পরে একসময় লিখব বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা নিয়ে। 

 

অম্ল নয়, শুধু মধুর সেসব অভিজ্ঞতা। সত্যিই আমি অত্যন্ত ভাগ্যবান একজন শিক্ষক। আমার বর্তমান কর্মস্থল বল স্টেট আমাকে শিক্ষক হিসেবে পূর্ণতা দিয়েছে। একজন বিদেশি হয়েও যে মর্যাদা, সম্মান, ভালোবাসা এখানে পেয়েছি তা বর্ণনাতীত। এত প্রাপ্তির পরেও কেন জানি রা বি’ র পরিসংখ্যান বিভাগ আমাকে ভীষণভাবে পিছু টানে। এই বিভাগ ছেড়ে গেছি প্রায় ১৪ বছর। বিভাগের সাথে যোগাযোগ রেখেছি সবসময়। প্রতিবছর কখনো একবার আবার কখনো দুইবার বিভাগে এসেছি। কিন্তু কোভিডের পর থেকে একটা বিচ্ছিন্নতা ঘটে গেছে। আর এখন বাধ সেধেছে শরীর। রাজশাহীতে এসে প্রথমেই ছুটে গিয়েছি বিভাগে অথচ এবার রাজশাহী আছি ৫ মাস হয়ে গেছে, অথচ একদিনের জন্যও যাওয়া হয়ে ওঠেনি। এরই মাঝে আমার সম্মানিত শিক্ষক, সহকর্মী, বন্ধু, ছাত্রছাত্রীরা কষ্ট করে আমাকে দেখতে এসেছেন। তবে আমি সবচে’ বিস্মিত হয়েছি এটা দেখে যে আমার সাথে দেখা করতে এসেছে অসংখ্য এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা। 

 

এরা কেউই আমার সরাসরি ছাত্রছাত্রী নয়, এমনকি অনেকেই পরিসংখ্যান বিভাগের ছাত্রছাত্রীও নয়। ওদের ক্লাস নেইনি, পড়াইনি, কিছুই করিনি। অথচ কী অবাক কান্ড! ওরা আমাকে স্মরণে রেখেছ। আমার সাথে দেখা করতে এসেছে। সাথে করে নিয়ে এসেছে একগাদা উপহারের ডালি। সত্যি আমি ভীষণ বিস্মিত, অভিভূত এবং আনন্দিত। আজকাল ছাত্রছাত্রীরা বর্তমান শিক্ষকেরই খোঁজ খবর রাখেনা।ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক একদম তলানিতে এসে ঠেকেছে। সম্মান তো দূরের কথা, ছাত্রের হাতে প্রাণ যাচ্ছে শিক্ষকের। এমন দুঃসময়ে দাঁড়িয়ে এতটা প্রাপ্তি সত্যিই ভাগ্যে লেখা না থাকলে জোটেনা। আমার সবচে বড় অনুপ্রেরণা, সবচে বড় শক্তি হল ছাত্রছাত্রীদের শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা। 

 

জীবন খাতার হিসাবের পাতায় প্রাপ্তির অংক যতই শূন্য থাক অন্তত এই জায়গায় আমি  পূর্ণ আর তাতেই সার্থক এ জনম। দেশে বিদেশে আমার অসংখ্য গুণগ্রাহী ছাত্রছাত্রী বা ছাত্রছাত্রীতুল্য সবার প্রতি রইল আমার নিরন্তর ভালোবাসা, শুভ কামনা আর আশীর্বাদ। তিরিশ বছরের শিক্ষকতা জীবনের উপলব্ধি- সবাইকেই চলে যেতে হয়, আমিও চলে যাব, তবে এই বিশ্বাস নিয়েই যাচ্ছি যে আমি তোমাদের মাঝে বেঁচে রব।

Check out our other content

Check out other tags:

Most Popular Articles